একের বেদনা অন্যের বোঝার কি শক্তি আছে!


‘একের বেদনা অন্যের বোঝার কি শক্তি আছে!’ শিরোনামে সমসাময়িক অনিয়ম আর নৈরাজ্য নাট্য বর্ণনায় ফুটিয়ে তুলেছেন প্রথিতযশা লেখক ও সাংবাদিক লিয়াকত হোসেন খোকন
পর্ব – ১
লালু আর টুকু দুই বন্ধু। লালুর স্ত্রীর নাম খুশি। আর টুকুর স্ত্রীর নাম মনু। লালুর দুই মেয়ে মালেকা ও রেবেকা। দু’জনে কলেজের ছাত্রী।
টুকুর দুই ছেলে সজীব আর সজল। ওরাও কলেজে পড়ে। লালু কোর্টের পেশকার। টুকুও পেশকার।
দৃশ্য -এক
লালু আর টুকুর দেখা বাজারে।
লালু – টুকু, বাজারে এলাম সয়াবিন তেল কোথাও  পেলাম না। দোকানের পর দোকানে গিয়েও পেলাম না সয়াবিন তেল।
টুকু – পাবি কি ভাবে? মানুষ হয়ে গেছে সবাই নেতা।
যে পারে সে ক্ষমতা দেখায়। কথায় কথায় জিনিসপত্রের দাম বাড়ায়। তেল নিয়ে করে লুকোচুরি খেলা।
লালু – ভোজ্য তেলের বাজারে রোজার শুরু থেকেই অস্থিরতা ছিল, দামও ছিল বাড়তি। গত দুই বছর ধরে প্রায় একই অবস্থা। একের বেদনা অন্যের বোঝার কি শক্তি আছে!
টুকু – কিন্তু হঠাৎ করেই হাটবাজার, পাড়া -মহল্লার মুদির দোকান থেকে প্রায় উধাও হয়ে গেছে সয়াবিন তেল, পাম অয়েল। এ যেন তেল নিয়ে তেলেসমাতি কারবার।
লালু – ও টুকু, টুকু রে হঠাৎ করে বাজার থেকে সয়াবিন তেল উধাও হওয়ার কারণ কী?
টুকু – এক দোকানি বলল, ইন্দোনেশিয়া কয়েক দিন হয় পাম অয়েল তেল রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে।
আর্জেন্টিনাও সয়াবিন তেল রপ্তানি সীমিত করার ঘোষণা দিয়েছে।
লালু – না কি এর পেছনে অন্য কারণ আছে?
টুকু – এক ভদ্রলোক বলল, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রতি মাসে সয়াবিন, পাম অয়েলের যে দর নির্ধারণ করে দেয়, তা একটি মহলের পছন্দ নয়। সেই মহলের দাবি, ব্যবসায়ীরা নিজেরাই তেলের দর নির্ধারণ করবে।
লালু – মধ্যখান দিয়ে একটি চক্র সয়াবিন তেল, পাম অয়েল তেল নিয়ে লুকোচুরি খেলা শুরু করে দিয়েছে। যে জন্য আমরা বিপাকে পড়েছি।
একজন পথচারী – আরে ভাই, রাব্বানী হোটেলে নাস্তা করে এলাম, পরটা -ভাজি নিলাম। ভাজি তেলে ভাসছে। ওরা এত তেল পায় কোথায়? পরটা তো তেলে চক চক করছে।
টুকু – দেখেন গিয়ে কত রেস্তোরাঁর মালিক আর ব্যবসায়ীরা খাটের তলে, বাথরুমে শত শত তেলের বোতল রেখে দিয়েছে। এরা হল কি জানেন, দেশের দুশমন, এরা তো ফেরাউনের বংশধর।
পথচারী – কেন, তরমুজ ব্যবসায়ীরাও তো ফেরাউনের বংশধর। ফেরাউনের বংশধর যদি না হয়, তাহলে কেন তরমুজ কেজি দরে বিক্রি করবে?
লালু – তেল খেতে খেতে দেশের নব্বই ভাগ মানুষের পেটে গ্যাস জমে গেছে। গ্যাসের যন্ত্রণায় টিকতে পারছি না, ওষুধ খেয়েও কাজ হচ্ছে না।
টুকু ( হাসতে হাসতে) – আমেরিকা চারিদিকে গ্যাস খুঁজছে, বাংলাদেশের নব্বই ভাগ মানুষের পেটে যে গ্যাস আছে, তা কি ওদের নজরে পড়ে না?
দৃশ্য – দুই 
সজীব ও সঝলের মধ্যে কথপোকথন
সজল – এবারের ঈদে নাড়ির টানে ঢাকা ছেড়েছেন অসংখ্য মানুষ। এ বাড়ি যাওয়া ও ফেরা এবং আনন্দ উদযাপন করতে গিয়ে বেপরোয়া যান চলাচলের কারণে সড়কে ঘটেছে শতাধিক দুর্ঘটনা। আর এতে আহত হয়েছেন কয়েকশো মানুষ।
সজীব – তাদেরকে ছুটতে হয়েছে হাসপাতালে। এবার আহতদের ৭৫ শতাংশই তিন ও দুই চাকার ছোট পরিবহণে দুর্ঘটনার শিকার। দুর্ঘটনায় ১১ দিনের মধ্যে নিহত হয়েছেন ১৩৯ জন। এরমধ্যে ৫৬ জন মোটরসাইকেল আরোহী ছিলেন।
সজল – যাদের পরিবারের নিকটজন মারা গেছেন তারাই বোঝেন তাদের বেদনা। অন্যের বোঝার কি শক্তি আছে!
সজীব – ঈদুল ফিতরের পরের দিন থেকেই রাস্তাতে মানুষের ঢল নেমেছে। বৃষ্টিপাতের দরুন ঈদের দিনের আনন্দ অনেকটাই অপূর্ণ থেকে গিয়েছে সেটাকে পুষিয়ে নিতে মানুষ বেরিয়ে পড়েছে রাস্তাতে।
সজল – আমরা প্রত্যেক বছরই দেখে থাকি ঈদের দিনে একশ্রেণির তরুণ বাইক চালিয়ে পরিবহনের কোনও তোয়াক্কা না করে ঘুরে বেড়ায়। তাদের বেপরোয়া বাইক চালানোয় অন্যের বিপদ ঘনিয়ে আসে। এই সময়ে বেড়ে যায় দুর্ঘটনার সংখ্যা।
সজীব – কারও হাত -পা -কোমর ভাঙে, মাথায় গুরুতর চোট, অঙ্গহানি, কেউবা একেবারে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। কত নিরীহ অসহায় নিষ্পাপ প্রাণ অকালে ঝরে যায়। উৎসব পর্বে দুর্ঘটনা লেগেই থাকে।
সজল – সরকার প্রশাসন থেকে প্রতিনিয়ত জনসাধারণকে পথ নিরাপত্তা পথ দুর্ঘটনা সংযত সতর্কতার সাথে গাড়ি চালানোর কথা বলা হচ্ছে। অথচ মানুষের সে সমস্ত দিকে খুব একটা নজর নেই।
সজীব – ঈদ – পূজোতে তরুণ প্রজন্ম যেন নিয়ম –
নীতির ধার না ধরে বাইকের গতিতে সীমায় পৌঁছিয়ে আনন্দ উচ্ছ্বাসে তীব্রতায় ভেসে যেতে চাই।
বলতে পারিস সঝল, এখন প্রশ্ন আর কতদিন জনসাধারণরা এই দুর্ঘটনার নীরব সাক্ষী হয়ে বেঁচে থাকবে।
সজল – বৃহত্তর জনসমাজ যদি প্রতিবাদ না করে তবে প্রশাসন স্বতঃস্ফূর্তভাবে ট্রাফিক আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে তৎপর হবে না।
সজীব – দুর্ঘটনা রোধের প্রতিকার কি হতে পারে?
সজল – প্রথমত, প্রত্যেক অভিভাবক ও অভিভাবিকাকে তাদের সন্তানদের সচেতনতার বার্তা প্রদানে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে বাবা –
মায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। তারা যদি কঠোর উপযুক্ত ও দায়িত্বশীল আচরণ পালন করে তাহলে অবশ্যই সন্তানেরা বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাতে পারবে না।
বন্ধু দীপকের আগমন।
দীপক – সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করতে প্রশাসনকেই যথাযোগ্য কর্তব্যনিষ্ঠ আইন অনুযায়ী ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশেষ করে রাস্তাঘাটে আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। একমাত্র চরম ব্যবস্থা গ্রহণ ও শাস্তি প্রদানেই ট্রাফিক আইন প্রত্যেকে মেনে চলতে বাধ্য হবে।
সজল – ট্রাফিক আইন ভঙ্গকারীদের কোনও অজুহাত, অপ্রাসঙ্গিক কারণ গ্রাহ্য করা হবে না। একবার সর্বোচ্চ শাস্তির মুখে পড়লেই দ্বিতীয়বার কেউ অবলীলায় ট্রাফিক আইন ভাঙার সাহস পাবে না।
সজীব – পথ নিরাপত্তা আইনের কার্যকারিতা ও বাস্তবিকতাকে জনসমক্ষে সুষ্ঠু ও নিরবচ্ছিন্নভাবে সারা বছর প্রচার করতে হবে। প্রশাসনের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে পথ নিরাপত্তা এবং ট্রাফিক আইনকে মান্য করতে সহযোগিতা হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
দীপক – সমাজের প্রত্যেকে দায়িত্বশীল ও বিবেচকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে নিজেদের শিক্ষিত নাগরিক হিসেবে গড়ে তুললে ট্রাফিক আইনের মান্যতায় কমে যাবে পথদুর্ঘটনা। এই মহান দায়িত্ব দেশের প্রতিটি মানুষের।
সজীব – আমরা দেখতে চাই না আর একটিও হৃদয়বিদারক পথদুর্ঘটনা। আর একটিও নিষ্পাপ প্রাণের ধারা যেন খসে না পড়ে অকালে। এ শপথ নিতেই হবে বৃহত্তর ও মানবজাতির স্বার্থে।
দীপক – সজীব,  কালকে কলেজ খুলবে। সময় মতো চলে আসবি, অনেক কর্মসূচী আছে  তোর আর আমার। একটা মজার ব্যাপার….
সজীব – বল তো শুনি।
দীপক – আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে এক বস্তা ভর্তি চাল পাঠানো হয়। আগের বস্তার চাল শেষ না হওয়ায় মা ওই বস্তা খোলেনওনি। হঠাৎ করে গ্রাম থেকে কাকীমা ফোন করে জানায়, চালের বস্তায় ছ’ভরি সোনার গয়না আছে কি-না। মা তার কথা মত বস্তা খুলে দেখেন সত্যিই তো!
সজীব – ছ’ভরি সোনা এখন কার কাছে? মায়ের কাছে।
দীপক – কাকিমাদের কাছে আমাদের ৫ লক্ষ টাকা পাওনা আছে। বহুবার তা চেয়েও আমরা পাইনি।
দেখ তো সজীব, টাকাটা আমরা কিভাবে পেয়ে গেলাম। মা বলেছে, টাকা না দিলে তিনি গয়না দিবে না।
সজীব – ছ’ভরি সোনার দামও তো এর সমানসমান।
দৃশ্য – তিন 
মালেকা ও রেবেকা বাসার ছাদে বসে আছে। হঠাৎ পাশের বিল্ডিংয়ে একটা হনুমান দেখে সেটার দিকে তাকিয়ে রইল। হনুমানটা চোখের আড়াল হতেই –
মালেকা – জঙ্গলের অসুস্থ হনুমান চিকিৎসা করাতে সোজা চলে এল ডাক্তার বাবুর চেম্বারে। শুধু তাই নয়, ইশারা করে দেখিয়ে দিল ওষুধ দাও।
রেবেকা – কি বলিস, তাই না-কি রে। হনুমান যদি মানুষের মত কথাবার্তা বলতে পারত, তাহলে বোধহয় সমাজে মানুষের কোনই গুরুত্ব থাকত না।
মানুষের চরিত্র আজ যে পর্যায়ে চলে গেছে তারচেয়ে জঙ্গলের একটা পশুর চরিত্র অনেক অনেক ভাল।
মালেকা – ঠিকই বলেছিস। মানুষের মধ্যে কি আর মানবিকতা আছে। ভাই হয়ে ভাইকে খুন করে, বৃদ্ধ বাবা -মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠায়। কেন যে একটা পশু হয়ে জন্ম নিলাম না, পশু হয়ে জন্ম নিলে আমি থাকতাম আফ্রিকার জঙ্গলে।
রেবেকা – আমি পশু হয়ে জন্ম নিলে থাকতাম ভারতের গির জঙ্গলে। এবার বল হনুমানটার কথা।
মালেকা – হনুমানটা শরীরের অসুবিধা কোথায় তাও দেখিয়ে দেয়। ওই ডাক্তার তৎক্ষনাৎ পশু চিকিৎসকের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে হনুমানকে ওষুধও দিলেন। ওষুধ দেয়ার পর প্রায় দু’ঘন্টা বেডে শুয়ে থাকল হনুমানটি।
রেবেকা – ঘটনাটি কি আমাদের দেশের?
মালেকা – আমাদের দেশে হলে তো ভালোই হত। অন্তত অমানুষদের লজ্জা হত এই জন্য যে, হনুমান ডাক্তারদের কাছে আসতে শিখেছে, চিকিৎসা নিতে শিখেছে। অসভ্যতা কাকে বলে তা জানে না হনুমান।
ঘটনাটা ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ার সিমলাপালের দুধরাজপুর গ্রামে।
রেবেকা – হনুমানটা যে ডাক্তারের চেম্বারে এসেছিল সেই ডাক্তারের নামটা কি?
মালেকা – ডাক্তার অনিমেষ পাল আর তাঁর চেম্বারে এসেছিল হনুমানটি। ডাক্তার অনিমেষ পাল চেম্বারে গিয়ে দেখতে পায়, মাঝবয়সী হনুমানটি রোগীদের বসার আসনে শুয়ে আছে। ওই হনুমানটি একটি জলের ট্যাপ খুলে জল খেয়ে তারপর ট্যাপটি যথারীতি বন্ধও করে দেয়।
রেবেকা – বাহ কত বুদ্ধিমান হনুমানটি। মানুষের এরকম বুদ্ধি কম, আছে শুধু কুবুদ্ধি।
মালেকা – হনুমানটি রোগীদের ভিড় ঠেলে সরাসরি ডাক্তারের টেবিলের উপর মুখোমুখি বসে। ওষুধের খাপ নিয়ে ডাক্তারকে ইশারা করে দেখায় ওষুধ দাও।
শুধু তাই নয়, চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় চোখে যন্ত্রণা হচ্ছে।
রেবেকা – তারপর কি হল?
মালেকা – চোখে ওষুধ নেয়ার পর ব্যথানাশক ওষুধ হনুমানটি খেয়ে নেয়। তারপর হনুমানটি চলে যায় নিজের আবাসস্থল জঙ্গলে।
লিয়াকত হোসেন খোকন
রূপনগর, ঢাকা, বাংলাদেশ।